ব্যবসা বা উদ্যোগ শুরু করার জন্য সাহস ও ব্যবসা-ধারণার পরই যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তা হলো পুঁজি। অনেকেই তাঁদের ‘বিলিয়ন ডলার আইডিয়া’ টাকার অভাবে পূরণ করতে পারেন না। আবার এটা ঠিক যে উদ্যোগে সাফল্যের রেখা দেখা না গেলে অন্যরা সেখানে বিনিয়োগ করতে চান না।
একজন তরুণ উদ্যোক্তার তাহলে কী করার আছে? ব্যবসা শুরু বা এগিয়ে যাওয়ার পুঁজি জোগাড়ের সাতটি উপায় এখানে তুলে ধরা হলো—
১. নিজের জমানো টাকা
সম্ভবত এটি বহুল প্রচলিত পদ্ধতি। যাঁরা উদ্যোক্তা হতে চান, তাঁরা আগেভাগেই টাকা জমাতে শুরু করেন। আমাদের দেশের উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে এটি হয় শিক্ষাজীবনে টিউশনির টাকা। জাতীয় এসএমই পুরস্কার বিজয়ী চামড়াজাত পণ্যের উদ্যোক্তা তানিয়া ওয়াহাব কিংবা অন্যরকম গ্রুপের চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসানের শুরু টিউশনির জমানো টাকা দিয়ে। তানিয়া ওয়াহাব শুরু করেছিলেন ১০ হাজার টাকা ও মাহমুদুল হাসান শুরু করেছিলেন ছয় হাজার টাকা দিয়ে। আবার অনেকে প্রথমে কিছুদিন চাকরি করে শুরুর মূলধন জোগাড় করেন। আইটি ক্ষেত্রের অনেকে তাঁদের শুরুর পুঁজি জোগাড় করেন ফ্রিল্যান্সিং করে। বিভিন্ন ফ্রিল্যান্সিং সাইটে কাজ করে প্রাথমিক পুঁজি জোগাড় করে ফেলা যায়। আবার অনেকে বিনা পুঁজিতে কাজ শুরু করেন। এসব ক্ষেত্রে তাঁরা নির্ভর করেন পরিচিত জনের ওপর। যেমন মুন্নু গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা হারুনুর রশীদ মুন্নু পরিচিত জনের ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়ে আর স্টেশনারি দ্রব্য সরবরাহ করে শুরু করেছেন। নিজের টাকা দিয়ে শুরু করে ধীরে ধীরে নিজের ব্যবসা উদ্যোগকে বড় করে নেওয়া যায়।
২. পরিবারের শক্তি
মা–বাবা, ভাইবোন কিংবা পরিবারের অন্যান্য সদস্যের কাছ থেকে টাকা নেওয়াটা অনেক সময় কঠিন মনে হয়। কিন্তু উদ্যোগের জন্য তাঁদের কাছ থেকে টাকা নিতে পারাটাই উদ্যোক্তার প্রথম বিজয়। কারণ, একজন উদ্যোক্তাকে তাঁর পণ্য বা সেবা বিক্রি করতে প্রতি পদে পদে মানুষকে বোঝাতে হয়। পুরোটাই একটা আলোচনার বিষয়। এ জন্য শুরুতে পরিবারকে বোঝাতে পারলে বোঝানোর ব্যাপারটা আয়ত্ত হয়ে যায়। বিশেষ করে আমাদের দেশে মধ্য বা নিম্নমধ্যবিত্ত মা–বাবা সন্তানকে উদ্যোক্তার বিপদসংকুল পথে ঠেলে দিতে চান না। কাজেই আপনি যদি আপনার মা–বাবাকে বুঝিয়ে তাঁদের কাছ থেকে শুরুর পুঁজি জোগাড় করতে পারেন, তাহলে সেটা আপনার জন্য একটা বড় অর্জনও বটে। মোহাম্মদী গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও ঢাকা নগরের প্রয়াত নগরপিতা আনিসুল হক তাঁর বাবার জমানো ৮৪ হাজার টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিষ্ঠাতা আনোয়ার হোসেনের মা তাঁর সর্বশেষ সম্বল রুপার চুড়ি বিক্রি করে ছেলেকে দিয়েছিলেন ব্যবসা শুরু করতে। পরিবারের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার আর একটা সুবিধা হলো নিখরচায় অভিজ্ঞ পরামর্শক হাতের কাছে পাওয়া।
৩. ক্রাউডসোর্সিং (গণ তহবিল)
২০০৭ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন বন্ধু পুঁজি জোগাড়ের এক বুদ্ধি বের করেন। তিনজন মিলে তাঁরা পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের এক বড় তালিকা বানিয়ে সবার কাছ থেকে দুই হাজার টাকা করে ধার নেন। মোট ৮০ জন তাঁদের সহায়তা করেন। সেই টাকা দিয়ে তাঁরা তাঁদের উদ্যোগ শুরু করেন এবং পরে সেই টাকা ফেরত দিয়ে দেন। অনেকেই টাকা ফেরত নিতে চাননি। তখন তাঁরা তাঁদের উপহার দেন। এ রকম গণমানুষের কাছ থেকে চাঁদা তুলে ব্যবসা শুরু করাটা আমাদের দেশে খুব একটা জনপ্রিয় না হলেও পশ্চিমে এটির ভালোই চল আছে। এ রকম অনেক ওয়েবসাইট আছে, যাঁর মাধ্যমে উদ্যোক্তারা পুঁজি সংগ্রহ করতে পারেন। এমন একটি জনপ্রিয় ওয়েবসাইট হলো কিকস্টার্টার (https://www.kickstarter.com/)। সেখান থেকে পুঁজি সংগ্রহ করা ছাড়াও পণ্যের আগাম বিক্রি করেও টাকা সংগ্রহ করা যায়। বাংলাদেশে এমন কোনো জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম এখনো গড়ে ওঠেনি। কিন্তু আপনি নিজে থেকে পরিচিত–স্বল্পপরিচিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করতে পারেন।
৪. ব্যবসা পরিকল্পনা ও উদ্ভাবনী ধারণার প্রতিযোগিতা
প্রায় সব দেশে নতুন উদ্যোক্তাদের অনুদান ও পুঁজি সহায়তার জন্য নানা রকম প্রতিযোগিতা, সামিটের আয়োজন করা হয়। এসব প্রতিযোগিতার প্রাইজমানিও হয় বড় অঙ্কের। সম্প্রতি সমাপ্ত বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন ফান্ডের প্রথম স্থান অধিকারী পেয়েছেন ৮৫ লাখ টাকার পুরস্কার। এ ছাড়া সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নিজের আইডিয়া তুলে ধরে বিজয়ী হওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রে টাকার পাশাপাশি মেন্টরিং ও মার্কেট অ্যাকসেসের সুবিধাও পাওয়া যায়। বাংলাদেশ সরকার আইডিয়া প্রকল্প (www.idea.gov.bd) নির্বাচিত ধারণাগুলোকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অনুদান দিয়ে থাকে।
৫. ব্যাংকঋণ
ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের মাধ্যমেও ব্যবসার জন্য পুঁজি জোগাড় করা যায়। তবে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আইডিয়া পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে ঋণ দিতে উৎসাহ দেখায় না। আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পাওয়ার জন্য ব্যবসার আইনি বাধ্যবাধকতা যেমন ট্রেড লাইসেন্স, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পরিবেশ ছাড়পত্র, প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় প্রভৃতি থাকতে হয়। ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য তহবিল সরবরাহের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো চলতি মূলধনও সরবরাহ করে থাকে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের কার্যাদেশের বিপরীতে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণসুবিধাও পাওয়া যায়। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে নিজেকেও ‘ব্যাংকেবল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। এ জন্য বেচাকেনা থেকে শুরু করে কর্মীদের বেতনাদি পরিশোধে ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই।
৬. ক্ষুদ্রঋণ
উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। এটি অনেক সময় উদ্যোক্তারা বাধা মনে করেন। কিন্তু এখন অনেক ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী সংস্থা আছে, যারা এসব ক্ষেত্রে এগিয়ে আসে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠান থেকে ক্ষুদ্র ঋণ পাওয়াটা ব্যাংকের তুলনায় অনেক সহজ। তবে অনেক সময় এ ঋণের সুদের হার বেশি ও সময়সীমা কম হয়ে থাকে। সাধারণত যাঁদের স্বল্প পুঁজি দরকার, তাঁরা এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হতে পারেন।
৭. এনজেল ও ভেঞ্চার বিনিয়োগকারী
বিশ্বব্যাপী উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার দুটি বড় উৎস হলো এনজেল ও ভেঞ্চার বিনিয়োগকারী। এনজেল বিনিয়োগকারীরা উদ্যোক্তাদের কষ্টের জায়গাগুলো যেমন সহজে বুঝতে পারেন, তেমনি চট করে এর সম্ভাবনাও দেখতে পান। কারণ, এনজেল বিনিয়োগকারীদের বড় অংশ নিজেরাই একসময় স্টার্টআপ উদ্যোক্তা ছিলেন। বাংলাদেশে এনজেল বিনিয়োগকারীদের বেশ কয়েকটি নেটওয়ার্ক রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ এনজেল খুবই সক্রিয়। এনজেল বিনিয়োগকারী শুধু নিজেরা বিনিয়োগ করে ক্ষান্ত হন না, পরবর্তী ধাপে আরও বিনিয়োগের জন্য চেষ্টা করেন। যেহেতু স্টার্টআপ ইকো সিস্টেমে তাঁদের একধরনের পরিচিতি রয়েছে, তাই তাঁদের সংযোগ উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগপ্রাপ্তিতে সহায়ক হয়। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠান হলো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিনিয়োগ করে। উদ্যোগ ও উদ্যোক্তাকে যাচাই করে তারা বিনিয়োগ করে থাকে। বাংলাদেশে সক্রিয় ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা তাদের অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া যাবে।
Source: Prothom Alo
Startup
Virtual Assistants 365
Inspiration
উদ্যোক্তা ও ব্র্যান্ডিং
Startup
Virtual Assistants 365